সুস্থ জাতি গঠনের পূর্বশর্ত হলো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। শুধুমাত্র আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ বা চিকিৎসা সুবিধা বাড়িয়েই স্বাস্থ্যব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়—এমন মত প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। তাঁর মতে, জাতির স্বাস্থ্যের ভিত্তি গড়ে ওঠে খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টি ও পরিবেশগত সচেতনতার উপর। তাই এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে জাতীয় উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাবে না।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) মিলনায়তনে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নুরজাহান বেগম এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “রোগপ্রতিরোধে মনোযোগ না দিলে গোটা দেশকে হাসপাতাল বানালেও কোনো লাভ হবে না। পুষ্টিহীনতা থাকলে মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ ঘটে না, ফলে মনোযোগ কমে, কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং শরীর রোগপ্রতিরোধে দুর্বল হয়ে পড়ে।”
নুরজাহান বেগম আরো বলেন, শুধু খাদ্যের পরিমাণই নয়, খাদ্য প্রস্তুতের প্রক্রিয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর সবজি ও তরকারি যদি ভুল পদ্ধতিতে রান্না করা হয়, তবে তার পুষ্টিগুণ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া কৃষিখাতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
তিনি শিশুদের ফাস্টফুডে আসক্তির বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার মতে, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় মাঠ, উঠোন ও খেলার উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে শিশুরা মোবাইল, ইন্টারনেট এবং ফাস্টফুডে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নুরজাহান বেগম বলেন, “অনেক আন্দোলন দেখি, কিন্তু দূষণমুক্ত শহর বা খেলার মাঠের দাবিতে কোনো আন্দোলন দেখি না।”
ডেঙ্গুর মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে—এ বিষয়টিকে গভীর উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর মতে, এসব রোগে মৃত্যুর হার কমাতে হলে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খোরশেদ আলম। তিনি জানান, সরকারের ২৩টি মন্ত্রণালয় সরাসরি পুষ্টি কার্যক্রমে জড়িত। তবুও শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। হাঁটার অভ্যাস কমে যাচ্ছে, শিশু ও কিশোররা স্থূলতায় ভুগছে, এমনকি প্রবীণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝেও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে।
খোরশেদ আলম বলেন, “দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন না আনলে সুস্থতা অর্জন সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলেও এখন ফাস্টফুডের দোকান গিজগিজ করছে। এই অবস্থায় বছরব্যাপী পুষ্টি ও সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি।”
স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, পুষ্টি শুধু একটি স্বাস্থ্য ইস্যু নয়, এটি কৃষি, খাদ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাই সম্মিলিত কর্মপরিকল্পনা ছাড়া পুষ্টির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, “জীবের টিকে থাকার জন্য যে শক্তি প্রয়োজন, সেটিই পুষ্টি। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো ২৮ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতিতে ভুগছে এবং ৯ শতাংশ শিশু ওয়েস্টিং সমস্যায় আক্রান্ত।” তিনি বলেন, এ অবস্থায় শুধু সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
তিনি আরো জানান, এখন অনেক শিশুই অতিরিক্ত পুষ্টির সমস্যায় ভুগছে, যাকে ‘ওভার নিউট্রিশন’ বলা হয়। এতে শিশুদের মধ্যে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো রোগ বেড়ে যাচ্ছে।