নির্মল ও সুস্থ জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, “রোগপ্রতিরোধের দিকে মনোযোগ না দিলে সারা দেশকে হাসপাতাল বানালেও কোনো লাভ হবে না।” তিনি বলেন, পুষ্টিহীনতার ফলে শিশুর মস্তিষ্ক ঠিকভাবে বিকশিত হয় না, মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ জন্য পুষ্টি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শুধু খাদ্যের পরিমাণ নয়, বরং খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ও গুণাগুণের দিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) মিলনায়তনে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নুরজাহান বেগম আরো বলেন, পুষ্টিকর খাবার যদি ভুল পদ্ধতিতে রান্না করা হয়, তাহলে তার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, খাদ্যের উৎস তথা কৃষি ক্ষেত্রেও সচেতনতা অপরিহার্য। বর্তমানে কৃষিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে।
শিশুদের ফাস্টফুডে আসক্তির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এখন শহরে বা গ্রামে খেলার মাঠ, উঠান প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে শিশুরা দিন দিন মোবাইল, ইন্টারনেট ও ফাস্টফুডের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, খেলাধুলা ও দূষণমুক্ত পরিবেশ ছাড়া শিশুদের এই অবস্থা থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, অনেক সামাজিক আন্দোলন দেখা গেলেও আজ পর্যন্ত খেলার মাঠ কিংবা দূষণমুক্ত শহরের দাবিতে কোনো আন্দোলন হয়নি।
তিনি ডেঙ্গুর মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগে মৃত্যুর বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন—“কেন ডেঙ্গুর মতো একটি রোগে মানুষ মারা যাবে?”
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খোরশেদ আলম জানান, সরকারের ২৩টি মন্ত্রণালয় সরাসরি পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু শহর ও গ্রামে মানুষের মধ্যে এখনো পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি হয়নি। হাঁটার অভ্যাস কমে যাচ্ছে, শিশু ও কিশোররা স্থূলতায় ভুগছে এবং এমনকি প্রবীণ ও শিক্ষিতদের মধ্যেও সচেতনতায় ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, “দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন আনা ছাড়া উপায় নেই। এখন গ্রামগঞ্জেও ফাস্টফুডের দোকান দেখা যায়। তাই বছরের সব সময়ই পুষ্টি ও সচেতনতা নিয়ে কাজ করতে হবে।”
স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, সচেতনতার পাশাপাশি একটি সুসংগঠিত কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন, পুষ্টির বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়; এর সঙ্গে খাদ্য, কৃষি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও জড়িত।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, জীবের টিকে থাকার জন্য যে শক্তি বিভিন্ন উৎস থেকে আসে, সেটিই পুষ্টি। কিন্তু দেশে এখনো ২৮ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতিতে ভুগছে এবং ৯ শতাংশ শিশু ‘ওয়েস্টিং’-এর সমস্যায় আক্রান্ত। এই পরিসংখ্যান আমাদের জন্য অশনি সংকেত। রাষ্ট্রের কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে শিশুরা শুধু অপুষ্টিতে নয়, বরং অতিপুষ্টিতেও আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে শিশুদের মধ্যে স্থূলতা ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার বাড়ছে।
এই আলোচনাগুলো থেকে স্পষ্ট যে, একটি সুস্থ জাতি গঠনে পুষ্টি, সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা ও পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। এসব বিষয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করাই এখন সময়ের দাবি।