বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং সংঘাতের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র ও শান্তির গুরুত্ব তুলে ধরে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। বৃহস্পতিবার জাপানে আয়োজিত নিক্কেই সম্মেলনে তিনি বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সাধারণ নির্বাচনের লক্ষ্যে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে গণতন্ত্রের একটি মসৃণ রূপান্তর সম্ভব হয়।
ড. ইউনূস বলেন, গণতন্ত্র কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি একটি মূল্যবোধ, যা ন্যায়বিচার, অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সেই কারণে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই, যেখানে সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং জনগণের সত্যিকারের মতামত প্রতিফলিত হবে।
বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাত এবং অস্থিরতা প্রসঙ্গে ড. ইউনূস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এশিয়া এবং এর বাইরেও একের পর এক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে শান্তি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধরা হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ, গাজা উপত্যকায় সহিংসতা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান সংঘর্ষ লাখো মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত করছে।
তিনি বিশেষভাবে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে সহিংসতা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং মানবিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি।
ড. ইউনূস বলেন, “বিশ্বব্যাপী যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে, অথচ সেই অর্থের অভাবে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। এটি মানবতা ও ন্যায়বিচারের চরম ব্যর্থতা।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি এই বিপুল অর্থ মানব উন্নয়নে ব্যয় হতো, তাহলে কতো মানুষের জীবন বদলে যেত, কতটা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো।
তার মতে, এই সংকট সমাধানে যুদ্ধ নয়, প্রয়োজন সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং মানবিক নেতৃত্ব। শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্বনেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এখন সময়ের দাবি। তিনি মনে করেন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বকে একটি শান্তিপূর্ণ, টেকসই এবং মানবিক সমাজে রূপান্তর করা সম্ভব।
ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য একটি উদার, সহানুভূতিশীল ও সমবেদনাশীল পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “শান্তি কেবল একটি ধারণা নয়, এটি একটি কর্মপন্থা—যা আমাদের প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত ও আচরণে প্রতিফলিত হতে হবে।”
এই বক্তব্যে ড. ইউনূস কেবল একটি রাজনৈতিক মতামত নয়, বরং একটি মানবিক চেতনার কথা তুলে ধরেছেন—যেখানে গণতন্ত্র, শান্তি এবং মানুষের মর্যাদাকে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।