বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় নোয়াখালী জেলায় ২৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি মৌসুমে একদিনে সর্বোচ্চ। টানা বৃষ্টি ও উঁচু জোয়ারের পানিতে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগের চরম রূপ।
বিশেষ করে উপকূলীয় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর, চরহাজারী, চরএলাহী এবং দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষ। এইসব এলাকাজুড়ে পুকুর, মাছের ঘের, ফসলি জমি ও বসতঘর প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে স্থানীয়রা।
নোয়াখালী শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা এখন এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জেলা কারাগার সড়ক, জজকোর্ট-কোর্টবিল্ডিং সংযোগ সড়ক, মাইজদী পাবলিক কলেজ রোড, আল ফারু একাডেমি সড়ক এবং নোয়াখালী সাইন্স অ্যান্ড কমার্স কলেজের সামনের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে না পারায় এসব এলাকায় যান চলাচল প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। পথচারী ও যানবাহন চালকরা সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে চলাচল করছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পৌরসভার ড্রেন ও খালগুলো দীর্ঘদিন ধরে আবর্জনায় বন্ধ হয়ে থাকার কারণে পানি নিষ্কাশনে ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে।
নোয়াখালী শহরের নাইস গেস্ট হাউসের মালিক মো. শওকত আলী বলেন, “জলাবদ্ধতা এখন স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরটি চারপাশের তুলনায় নিচু হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। পৌর কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন না করায় এই দুর্ভোগ কাটছে না।”
দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে উত্তাল ঢেউ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। নদ-নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে হাতিয়া ও কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে করে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
বাঁধ ভেঙে প্রবল জোয়ারের পানি গ্রামে ঢুকে বসতবাড়ি, শস্য ক্ষেত ও মাছের ঘের প্লাবিত করেছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফসল, শাকসবজি ও পুকুরের মাছ ভেসে গিয়ে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
মেঘনা নদীতে এমভি ফাহিম নামের একটি বড় পণ্যবাহী ট্রলার ৪ কোটি টাকার মালামালসহ ডুবে গেছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত জারি রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে অতিরিক্ত জোয়ারের পানির ঢল নিঝুম দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করেছে। এর ফলে সেখানে বসবাসকারী মানুষের পাশাপাশি জাতীয় উদ্যানের হরিণগুলোও খাদ্য সংকটে ও নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে।
এছাড়া চর ঈশ্বর, নলচিরা, ঢালচর, সুখচর ও চরঘাসিয়া এলাকার বহু বাড়িঘর, সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতিবছর এমন দুর্যোগ দেখা দিলেও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমদ জানান, “আমরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেড ক্রিসেন্টসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা একযোগে কাজ করছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়েছে।”
নোয়াখালী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিন নিম্নচাপের প্রভাবে আরও বৃষ্টি হতে পারে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গভীর নিম্নচাপ এখনো সক্রিয় থাকায় বৃষ্টি ও জোয়ার অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র উত্তাল রয়েছে, নদী-নালার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরও এলাকা প্লাবিত হতে পারে।”
নোয়াখালীর স্থায়ী বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীরা মনে করছেন, এই জেলার ভৌগোলিক গঠন, বিশেষ করে শহরের নিচু অবস্থান এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের প্রধান কারণ। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছরই এমন দুর্যোগ দেখা দেয়।
স্থানীয়রা আশা করছেন, এবার হয়তো কর্তৃপক্ষ স্থায়ী কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ময়লা পরিষ্কারের নিয়মিত তদারকি এবং নদীর পাড়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ—এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হলে দুর্যোগ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।