অর্থ উপদেষ্টার ঘোষণায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট: ইতিহাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একটি নতুন দিকচিহ্ন হয়ে থাকছে। এই প্রথমবারের মতো একটি অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট উপস্থাপন করছে, যেখানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছেন। সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিওর মাধ্যমে পূর্ব-রেকর্ডকৃত বাজেট বক্তৃতাটি প্রচার করা হয়।
এটি দেশের ৫৪তম বাজেট। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত থাকার কারণে এবার কোনো সরাসরি বিতর্ক বা আলোচনার সুযোগ না রেখেই বাজেট ঘোষিত হলো। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাজেট ঘোষণার পর জনমত গ্রহণ করা হবে এবং সেই অনুযায়ী সংশোধন করে এটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের খসড়া অনুমোদনের জন্য সোমবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে বৈঠকটি শেষ হয় দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে। এই বৈঠকেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়।
বাজেট ঘোষণার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আগামী ২৩ জুনের পর উপদেষ্টা পরিষদের আরেকটি বৈঠকে এটি উপস্থাপন করা হবে। সেখান থেকে অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করবেন এবং নতুন বাজেট কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত মোট বাজেটের পরিমাণ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বড়। এই বাজেটের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং পরিচালন ও অন্যান্য খাতে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বাজেটের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব ও ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এই ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ উৎসে সরকার ব্যাংক ও বন্ড থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে। আর বৈদেশিক ঋণ আসবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে।
বাজেটে বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে—২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংসদ না থাকায় এবার বাজেট পেশ করা হয়েছে একেবারেই ভিন্ন পদ্ধতিতে। বরাবরের মতো বাজেটের ওপর সংসদে আলোচনা কিংবা বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে বাজেটে প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এছাড়া বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে আগামীকাল, মঙ্গলবার (৩ জুন) বিকেল ৩টায়। সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার ঐতিহাসিক ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে, যেখানে সাংবাদিকরা উপদেষ্টাদের কাছে প্রশ্ন করতে পারবেন।
প্রতি বছর সাধারণত জুন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার বাজেট পেশ করা হয়। কিন্তু এবার ঈদুল আজহার তারিখ ৭ জুন হওয়ায়, ছুটি শুরু হওয়ার আগে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে সোমবার (২ জুন) বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে এবং ঈদের আগেই জনগণ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাজেট ঘোষণার পর সরকার জনগণের মতামত আহ্বান করবে, বিশেষ করে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। মতামতগুলো সংগ্রহ করে অর্থ মন্ত্রণালয় তা পর্যালোচনা করবে এবং চূড়ান্ত বাজেটে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হতে পারে। এরপর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা কার্যকর হবে।
এই প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি ব্যতিক্রম হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা ও সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটি একটি বাস্তবিক ও কার্যকর সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই বাজেট শুধুমাত্র আর্থিক পরিকল্পনার দলিল নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এই বাজেট একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা ও দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এবারের বাজেট দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার, বিনিয়োগ পরিবেশ স্থিতিশীল রাখা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এই বাজেট কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা আগামী অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক গতি-প্রবাহে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে।