নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা ও আন্তরিক আলোচনার পরিবেশ বিরাজ করছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও সুসংহত করবে বলে তিনি মনে করেন।
সোমবার বিকেলে ঢাকার বেইলি রোডে অবস্থিত ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় এই বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ইউনূস নিজেই। বৈঠকে অংশ নেয় বিএনপি-জামায়াতসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার মোট ২৮টি দলের প্রতিনিধি দল। বৈঠক শুরু হয় বিকেল ৪টার কিছু পর এবং তা চলে দীর্ঘ সময় ধরে।
এই বৈঠকের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংলাপের প্রথম পর্ব শেষ হয় এবং দ্বিতীয় পর্বের সূচনা ঘটে। এ সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আজ আমরা প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করেছি এবং দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হলো। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, প্রথম পর্বের আলোচনায় আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি—আমরা জুলাই সনদ গ্রহণ করবো।” তিনি আরও বলেন, “আলোচনার পরিবেশ অত্যন্ত সহযোগিতাপূর্ণ ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিকতা ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।”
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জানান, দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় এমন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে যেগুলোতে এখনো পুরোপুরি ঐকমত্য অর্জিত হয়নি, তবে দলগুলোর অবস্থান খুব কাছাকাছি। এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে গভীর ও খোলামেলা আলোচনা হবে, যাতে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানে পৌঁছানো যায়।
এদিকে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আমল সাংবাদিকদের জানান, সরকার আগামী বছরের ৩০ জুনের পরে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেবে না। তিনি বলেন, “নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এবং এই বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
বৈঠকের আয়োজন ও মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশবাসীর প্রত্যাশা এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এ ধরনের আলোচনার প্রতি নিবদ্ধ। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন অংশগ্রহণ ও সদিচ্ছা প্রমাণ করে যে, তারা দেশে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে আগ্রহী।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, চলমান আলোচনা পর্যায়ক্রমে সফল হবে এবং একটি জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে দেশের সামনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, “আমরা কোনো পক্ষকে বাদ দিয়ে নয়, বরং সবাইকে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চাই। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের এমন উদ্যোগ এবং সব দলের অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথে ইতিবাচক বার্তা বহন করে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ এই সংলাপকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
উল্লেখ্য, জুলাই সনদ বলতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে যৌথভাবে সম্মত হওয়া একটি দলিলকে বোঝানো হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এটি একটি মৌলিক ভিত্তি তৈরি করবে যার ওপর ভিত্তি করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা নির্ধারিত হবে।
পরিশেষে, এই রাজনৈতিক সংলাপ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। প্রধান উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে আন্তরিকতা ও সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা দেশের জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। সবার চেষ্টায় যদি একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে।