ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সৌজন্য সাক্ষাৎ
বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একটি সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছেন। বুধবার, ৪ মে তারিখে রাজধানী ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের শুরুতেই হাইকমিশনার কুক অধ্যাপক ইউনূসকে যুক্তরাজ্যের মর্যাদাপূর্ণ “কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড” অর্জনের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, এ পুরস্কার বাংলাদেশ ও অধ্যাপক ইউনূসের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রতিফলন। অধ্যাপক ইউনূস তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এই সম্মান শুধু আমার নয়, এটি বাংলাদেশেরও গর্বের বিষয়। এটি এক মহান মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ।”
বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা আরও জোরদার করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বিমান চলাচল বিষয়ে যৌথ উদ্যোগ, অভিবাসন ব্যবস্থাপনা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা। উভয় পক্ষই এসব বিষয়ে উন্মুক্ত মনোভাব নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার রোধ ও অবৈধভাবে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। হাইকমিশনার কুক এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানান এবং যুক্তরাজ্যের সম্ভাব্য সহায়তার আশ্বাস দেন।
আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অগ্রগতি। অধ্যাপক ইউনূস হাইকমিশনারকে জানান, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একটি টেকসই রাজনৈতিক পথনির্দেশনা তৈরির লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা ইতোমধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফার সংলাপ সম্পন্ন করেছে। দ্বিতীয় দফার আলোচনা এ সপ্তাহেই শুরু হচ্ছে এবং তা শিগগিরই শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উল্লেখযোগ্যভাবে, অধ্যাপক ইউনূস তাঁর আগ্রহের বিষয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে অবহিত করেন—তিনি চান, বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ ও সামুদ্রিক গবেষণা কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করতে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা লাভ করতে। তিনি বলেন, “ব্রিটিশ গবেষকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং আধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে আমাদের সামুদ্রিক গবেষণার সক্ষমতা বহুগুণে বাড়বে।” হাইকমিশনার কুক এ বিষয়ে সম্ভাব্য যৌথ গবেষণা উদ্যোগ, প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়েও আলোচনা করেন।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বিষয়ক সমন্বয়কারী লামিয়া মোরশেদ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ উপহাইকমিশনার জেমস গোল্ডম্যান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটি ছিল উভয় পক্ষের জন্যই অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীরতর করার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।
এদিকে, অধ্যাপক ইউনূসের সামনের সফর নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। তিনি আগামী ৯ জুন ঢাকা ত্যাগ করবেন এবং ১৩ জুন দেশে ফিরে আসবেন বলে জানা গেছে। সফরকালে তিনি যুক্তরাজ্যের উচ্চপর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেবেন। এই সফর বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বৈঠকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আলোচনার সূত্রপাত হয়। অধ্যাপক ইউনূস জানান, তিনি বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। তিনি ব্রিটেনের কাছ থেকে এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।
ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক বাংলাদেশের উন্নয়নে অধ্যাপক ইউনূসের অবদানের প্রশংসা করে বলেন, “আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা এই অগ্রযাত্রায় অংশীদার হতে আগ্রহী।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্কের ভিত্তি হলো পারস্পরিক সম্মান, আস্থা এবং সহযোগিতা। এই সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করতে আমরা কাজ করে যাব।”
উল্লেখ্য, কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড এমন একটি সম্মাননা যা আন্তর্জাতিক শান্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সহনশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য প্রদান করা হয়। অধ্যাপক ইউনূস এ পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গৌরব অর্জন করেননি, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বিশ্বদরবারে আরও উজ্জ্বল করেছেন।
এই সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আগামী দিনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব আরও গভীর হবে এবং শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও মানবিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে যুগোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
সাক্ষাৎ শেষে উভয় পক্ষই ভবিষ্যতে নিয়মিত উচ্চপর্যায়ের আলোচনা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এমন অনেক খাত রয়েছে, যেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি—আর এই অংশীদারিত্ব কেবল দুই দেশ নয়, বরং সারা বিশ্বের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে।”