প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিটেন্সই দেশের অর্থনীতিকে কঠিন সময় থেকে রক্ষা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। জাপানের রাজধানী টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এক কমিউনিটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় প্রবাসীদের পাঠানো অর্থই ছিল দেশের অর্থনৈতিক টিকে থাকার মূল ভিত্তি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশকে যখন ধ্বংসাবশেষের মুখে দাঁড় করিয়ে গিয়েছিল পূর্বতন সরকার, তখন সেই শূন্য কোষাগার ও দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও সামর্থ্য জুগিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই অবদান আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না। প্রবাসীদের প্রতি জাতি কৃতজ্ঞ। একমাত্র তাদের নিরলস প্রেরিত অর্থের কারণেই বাংলাদেশ আজ আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার যে দায়িত্ব পালন করছে, তা দেশের অব্যাহত অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ এবং অবদান আরও ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, “দেশ গঠনে প্রত্যেক প্রবাসী নাগরিকের অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। আপনাদের শুধু অর্থ প্রেরণ নয়, বরং দেশে ফিরে বিনিয়োগ ও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ দরকার।”
প্রবাসীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশে আপনাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং অনেকেরই ছোট-বড় ব্যবসা রয়েছে। এই যোগাযোগ ও সম্পর্ককে ভিত্তি করে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব এখন আপনাদের হাতেও।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা যদি সত্যিকার অর্থে একটি উন্নত ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে চাই, তাহলে প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ, এবং আন্তর্জাতিক দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। আপনাদের জাপান সরকারের ওপরও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ জাপানের সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়।”
প্রধান উপদেষ্টার তিন দিনের জাপান সফরের তৃতীয় দিনে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রথম সমঝোতা স্মারকটি হলো ডেভেলপমেন্ট পলিসি লোন, যার আওতায় বাংলাদেশ পাবে ৪১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ঋণ অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
দ্বিতীয় স্মারকটি হলো জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়াল-গেজ ডাবল লেন রেলওয়ে প্রকল্পে ৬৪১ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা। এই প্রকল্পটি দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে দ্রুত ও সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
তৃতীয় স্মারকটি হলো মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য স্কলারশিপ অনুদান, যার আওতায় বাংলাদেশ পাবে ৪.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অনুদান বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের জাপানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
এই সমঝোতা স্মারকগুলোতে বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলী এবং জাপানের পক্ষে রাষ্ট্রদূত শিনিচি সাইদা স্বাক্ষর করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস নিজে উপস্থিত থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলোর সাক্ষী হন।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ ও জাপানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “জাপান সবসময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে। আমরা চাই, এই বন্ধন আরও দৃঢ় হোক এবং দুই দেশই পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করে যাক।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই—যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মানবিক মূল্যবোধ থাকবে। এই লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন একটি কার্যকর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং দেশের জনগণের একাত্মতা।”
সন্ধ্যায় জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আয়োজিত নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ আলোচনা করেন তিনি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, প্রবাসীরা শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। তিনি বলেন, “আপনারা বিদেশে বসবাস করলেও বাংলাদেশকে ভুলে যাননি। এই মমত্ববোধই আমাদের জাতির শক্তি।”
তিনি যোগ করেন, “এই প্রজন্মের প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত, সচেতন ও প্রযুক্তি-দক্ষ। তাদের এই দক্ষতা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে।”
তিনি বলেন, “দেশ গঠনের দায় কেবল সরকারের একার নয়। একেকজন নাগরিকের সচেতন উদ্যোগেই গড়ে ওঠে একটি সমৃদ্ধ জাতি। তাই প্রবাসীদের উচিত নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে দেশের পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।”
প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আপনারাই আমাদের আসল রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আপনারাই বাংলাদেশের প্রতিনিধি। তাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করুন, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ বজায় রাখুন।”
প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই রেমিটেন্স নির্ভর অবদান শুধু আর্থিক নয়, বরং তা জাতির আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও দেয়। অধ্যাপক ইউনূসের মতে, এই শক্তিকে কেন্দ্র করেই নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথ রচনা করতে হবে।