দেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় সংকট ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। দীর্ঘদিনের এই চাপ কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত মাসিক ভোক্তা মূল্য সূচকের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৩২ শতাংশে, যা গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
মূল্যস্ফীতির পটভূমি
বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা শুরু হয় ২০২২ সালের আগস্ট থেকে, যখন হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এরপর থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থেকে যায় এবং তা কমানো সম্ভব হয়নি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বড় সংকটগুলোর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অন্যতম। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম দিকে মূল্যস্ফীতি কিছুটা স্থির থাকলেও সাম্প্রতিক দুই মাসে এটি নিম্নমুখী প্রবণতা দেখাচ্ছে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে পণ্য ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৩২ পয়সায়। এর আগে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.২৪ শতাংশ, যা এবারের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় সামান্য কম ছিল। অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির এই নিম্নমুখী প্রবণতাকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করছেন, তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী করতে আরও নীতি সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির চিত্র
ফেব্রুয়ারি মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্য মূল্যস্ফীতিও কমেছে। জানুয়ারিতে যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৭২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছে ৯.২৪ শতাংশে। শীতের মৌসুম হওয়ায় বাজারে সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া গেছে, যা খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার অন্যতম কারণ।
তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের অষ্টম মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতি ৯.৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ৯.৩২ শতাংশ।
এপ্রিল থেকে নতুন চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকদের মতে, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চ্যালেঞ্জ আসবে এপ্রিল থেকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। এ সময় ফসলের ক্ষতি হলে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতিকে পুনরায় বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের অভিমত
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতেও কমেছে, এ মাসেও কমেছে, যা ইতিবাচক। তবে এটি সাধারণ মূল্যস্ফীতি। স্থির আয়ের মানুষ যে পণ্যগুলো বেশি কেনেন, সেগুলোর মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিও দেখা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার খবর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতির হার কমলেও বাজারে পণ্যের মূল্যস্তর এখনও অনেক উঁচু রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে।
মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত হলেও সাধারণ মানুষের জন্য তা যথেষ্ট স্বস্তির কারণ নয়। বাজারে পণ্যের মূল্যস্তর এখনও অনেক বেশি, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা ও সরকারের নীতিগত পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে, বাজার পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।