নজরুল জয়ন্তী আজ

মো : সবুজ মিয়া
সময় : রবিবার, মে ২৫, ২০২৫

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী। বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য নক্ষত্র, যিনি প্রেম, বিদ্রোহ, সাম্য ও মানবতার প্রতীক হয়ে বাঙালির হৃদয়ে আজো চিরজাগরুক। ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’ এই প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে আজ কুমিল্লায় শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী কেন্দ্রীয় আয়োজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির মর্যাদা পাওয়ার পর এটাই প্রথম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান, তাই আয়োজনের মধ্যেও রয়েছে বিশেষ গৌরব ও আবেগ।

নজরুল ইসলামের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাকে। জীবনের প্রথম দিকে কাজ করেছেন রুটির দোকানে, হয়েছেন মসজিদের মুয়াজ্জিন ও মাজারের খাদেম। পরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা তার লেখায় প্রভাব ফেলে। এরপর সাংবাদিকতা, রাজনীতি এবং সাহিত্যের জগতে পদার্পণ করেন, যা বাংলা সাহিত্যকে করে তোলে গভীর ও সংগ্রামী।

নজরুলের কবিতা বাঙালির চেতনায় এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাকে এনে দেয় ব্যাপক পরিচিতি। সেখানে তিনি বলেন—

“আমি ত্রাস সঞ্চারী ভুবনে সহসা সঞ্চারী ভূমিকম্প।
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!”

এই সাহসী উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে নতুন ভাষার সূচনা করে—প্রেম ও প্রতিবাদের। এর পাশাপাশি ‘কামাল পাশা’ কবিতার মাধ্যমে তিনি মুসলিম বিশ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেন, যা ছিল সময়োপযোগী ও প্রগতিশীল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।

কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টির আরও একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে সংগীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান তিনি রচনা করেন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামি সংগীত, দেশাত্মবোধক গান, প্রেমের গান, গজল, ভক্তিমূলক গান ইত্যাদি। রাগ-রাগিণী, তাল ও সুরে বৈচিত্র্যের মাধ্যমে নজরুল বাংলা গানের ভাণ্ডারকে দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা। তাঁর সংগীত আজও নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে সমানভাবে গাওয়া হয়, মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে তার গান।

মানবতার কবি হিসেবে নজরুল সবসময় সমাজের অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নারী অধিকারের বিষয়ে তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তার লেখনী ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও সাহসী। ধর্মবিশ্বাস থাকলেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থান ছিল তার সৃষ্টির মূল উপজীব্য।

তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। একাধিকবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে তার প্রতিবাদী লেখার কারণে। জেলেই তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। এই লেখাগুলোতে যেমন রয়েছে কবির দ্রোহী মনোভাব, তেমনি ফুটে উঠেছে তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।

তবে নজরুলের জীবন ছিল শুধুই গৌরবের নয়, এর ছায়াচ্ছন্ন অধ্যায়ও রয়েছে। দীর্ঘ রোগভোগ, বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিনি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। ১৯৪২ সালে তিনি চিরদিনের মতো নীরব হয়ে যান। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাকে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। দীর্ঘ রোগভোগ শেষে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে নজরুল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।

জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বাণী প্রদান করেছেন। তারা কবির অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, নজরুল কেবল একজন কবি নন, তিনি একটি আন্দোলনের প্রতীক। তার বিদ্রোহী সত্তা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদের বারবার মাথা তুলে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করে।

এ বছর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তিন দিনব্যাপী নানা আয়োজন করেছে। এর উদ্বোধন হবে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বিকেল ৩টায়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। অনুষ্ঠানে দেওয়া হবে ‘নজরুল পুরস্কার ২০২৩ ও ২০২৪’। অনুষ্ঠানমালায় থাকবে আলোচনা সভা, সংগীত, আবৃত্তি, নাটক ও নৃত্যানুষ্ঠান।

এছাড়াও বাংলা একাডেমি, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ছায়ানট এবং বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্মী সংঘ নানা আয়োজনে অংশ নিচ্ছে। জাতীয় কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, সেমিনার, গান, পাঠ ও আবৃত্তির মাধ্যমে দিনটি স্মরণীয় করে তোলা হচ্ছে।

চেতনার প্রতীক, বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাহিত্য ও সংগীতের মাধ্যমে আজও আমাদের আলো দেখাচ্ছেন। সময়ের নিষ্ঠুরতা ও সমাজের অবিচার যেভাবে তাকে বারবার আঘাত করেছে, সেভাবেই তিনি বারবার দাঁড়িয়ে গেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আজ তার জন্মদিনে আমাদের দায়িত্ব শুধু তাকে স্মরণ করাই নয়, বরং তার আদর্শ ও চিন্তাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।

আজকের দিনে, জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছে সেই কবিকে, যিনি নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও মানবিক চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হোক আমাদের ভবিষ্যৎ পথচলা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

Tags

ChatGPT Icc T20 অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে মধ্যরাতে ঢাবিতে বিক্ষোভ আওয়ামী লীগ আপিল বিভাগে স্থগিত ইমরান খান ইসরায়েলি হামলা উপদেষ্টা পরিষদ এইচএসসি কোটা আন্দোলন খালেদা জিয়া মুক্ত গাজা গ্রেপ্তার ১২ চৌরাস্তা বাজার জামায়াত ড. ইউনূস ডিজিটাল বাংলাদেশ তারেক রহমান তৌহিদী জনতা ত্রিশাল দুদক দুর্নীতি ধানীখোলা নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ নাহিদ ইসলাম নির্বাচন পাকিস্তান প্রধান উপদেষ্টা প্রশ্নফাঁস ফিলিস্তিন বাংলাদেশ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সাংগঠনিক যাত্রা: শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কার্যক্রম শুরু বিএনপি বিজিবি ভারত ময়মনসিংহ মানবতা রাজনীতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা সমমান সিলেটে কারফিউর মধ্যেও থেমে নেই চিনি চোরাচালান ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়াল খেলাপি ঋণের পরিমাণ

পুরাতন খবর

এক ক্লিকে বিভাগের খবর