বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা-২০২৫: শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতার নতুন যুগে প্রবেশ
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক পরিবেশে শৃঙ্খলা, পেশাদারিত্ব এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে “বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা, ২০২৫” গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। নতুন এই বিধিমালায় বাণিজ্য সংগঠনগুলোর গঠন, পরিচালনা, নিবন্ধন, তদারকি ও শৃঙ্খলার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোকে একটি কাঠামোবদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
এই বিধিমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—যেসব ব্যক্তি ব্যাংক ঋণ খেলাপ করেছেন কিংবা কর ফাঁকি দিয়েছেন, তারা বাণিজ্য সংগঠনের কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এর মাধ্যমে সংগঠনের নেতৃত্বে আসার ক্ষেত্রে নৈতিকতা, আর্থিক জবাবদিহি ও সচ্ছলতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রোফাইল যাচাই-বাছাইয়ে এই বিধান কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিধিমালায় এফবিসিসিআই (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি)–এর পরিচালনা পর্ষদ এবং সাধারণ পরিষদের গঠনে বড় ধরনের সংস্কার আনা হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদে ৪৬ জন পরিচালক থাকবেন। এর মধ্যে থাকবেন একজন সভাপতি, একজন সিনিয়র সহসভাপতি এবং দুই জন সহসভাপতি।
নির্বাচনে বিভিন্ন শ্রেণির বাণিজ্য সংগঠনের সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চেম্বার গ্রুপ, অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ ও সাবস্ক্রাইবার গ্রুপ থেকে কোটার ভিত্তিতে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন। এটি সংবিধানসম্মত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এবং বহুবিধ খাত থেকে যোগ্য নেতৃত্ব আসার পথ সুগম করবে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বাণিজ্য সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রশাসনিক ও আর্থিক শর্ত পূরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—সংগঠনের নবায়ন সনদ, নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন, সাম্প্রতিক বার্ষিক সাধারণ সভার কার্যবিবরণী, এবং সদস্যপদ সংক্রান্ত ফি জমাদান।
একইভাবে, পরিচালনা পর্ষদের জন্য প্রার্থী হতে হলে তাকে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কার্যকরী সদস্য হতে হবে এবং পূর্ববর্তী সময়ে সংগঠনের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের প্রমাণ থাকতে হবে। অর্থাৎ, নেতৃত্বে আসার জন্য কেবল নামমাত্র সদস্য হওয়া যথেষ্ট নয়; প্রার্থীর পূর্ব কর্মকাণ্ড ও অবদানকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নতুন বিধিমালায় সাধারণ পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্যেও নির্দিষ্ট যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। সদস্যদের সংগঠনের নবায়ন সম্পন্ন থাকতে হবে, নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে এবং আর্থিক দায়মুক্তির প্রমাণ থাকতে হবে। এসব শর্ত পূরণ না হলে কেউ সাধারণ পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না।
নির্বাচনে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন নির্বাচন বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ডটি পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা ও নজরদারির দায়িত্বে থাকবে। নির্বাচন চলাকালীন সময়ে জাল বা ভুয়া কাগজপত্র দাখিল, ভোটার তালিকায় অনিয়ম কিংবা প্রভাব খাটানোর অভিযোগ পেলে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থী বা সদস্যের সদস্যপদ বাতিল বা প্রার্থিতা স্থগিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই বিধান সংযুক্ত করার মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে।
বিধিমালায় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর বার্ষিক সাধারণ সভা (AGM) আয়োজন, নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল ও সংগঠন বাতিলের মতো বিষয়গুলোও নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালনার নির্দেশনা রয়েছে। এর ফলে সংগঠনগুলোর প্রশাসনিক কার্যক্রমে জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত হবে।
নতুন এই বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ধারা ও শর্তের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, সরকার ব্যবসায়িক পরিবেশে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী ভূমিকা নিতে চায়। এতে বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে অনিয়ম কমবে, নেতৃত্বে আসবে যোগ্য ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন ব্যক্তি, এবং সরকারি তদারকি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে।