এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্তে কর্মবিরতি: রাজস্ব প্রশাসনে অচলাবস্থা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্তির সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো কলমবিরতি পালন করছেন দেশের কর, শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সকাল ১০টা থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন কর অঞ্চল, ভ্যাট ও কাস্টমস অফিসে একযোগে এই কর্মসূচি পালিত হয়, যা চলে বিকেল ৩টা পর্যন্ত।
এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় ধরনের কর্মকর্তা, যাঁরা একত্রে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। এসময় করদাতাদের সেবা কার্যত বন্ধ ছিল, যার ফলে রাজস্ব প্রশাসনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
সরকার গত সোমবার রাতে একটি অধ্যাদেশ জারি করে এনবিআর ও আইআরডি বিলুপ্ত করে নতুনভাবে দুটি বিভাগ গঠনের ঘোষণা দেয়—‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’। সরকারের ভাষ্যে, এই পরিবর্তন রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াবে। তবে কর্মকর্তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ এবং পর্যাপ্ত পর্যালোচনা ছাড়া গ্রহণ করা হয়েছে, যা রাজস্ব প্রশাসনের দীর্ঘদিনের কাঠামো ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাহ্য করে।
তিন দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবারও (প্রথম দিন) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কলমবিরতি পালন করা হয়। দ্বিতীয় দিন তা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। শনিবার তৃতীয় এবং শেষ দিনের কর্মসূচি একই সময়ে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন অঞ্চলের কাস্টমস হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও কর অঞ্চল অফিসে এই কর্মসূচির ফলে স্বাভাবিক কার্যক্রম থেমে গেছে। ঢাকার এনবিআর সদর দপ্তরের পাশাপাশি বেনাপোল, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বন্দর ও অফিসেও এ কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে।
এই অবস্থায় করদাতারা যেমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তেমনি আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ও রাজস্ব আহরণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, বাজেট প্রণয়ন এবং রপ্তানিসংশ্লিষ্ট জরুরি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন, যাতে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক কার্যক্রমে সরাসরি ব্যাঘাত না ঘটে।
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে ও তাদের দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে আন্দোলনকারীরা বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন।
‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ বলেছে, সরকার যদি এই সিদ্ধান্ত বাতিল না করে বা আলোচনায় না বসে, তবে তারা ভবিষ্যতে আরও কঠোর কর্মসূচি নিতে বাধ্য হবেন। অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, এই বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত শুধু প্রশাসনিক কাঠামো নয়, বরং জাতীয় রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার মূল ভিত্তিকেই দুর্বল করবে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, এনবিআর প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজস্ব প্রশাসনে যে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও নীতি কাঠামো গড়ে উঠেছে, তা হঠাৎ ভেঙে ফেলা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
তাঁদের মতে, এনবিআরের ভাঙন ঘটলে দক্ষতা হ্রাস পাবে, নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেবে এবং জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
তাঁরা আরও বলেন, একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য কর প্রশাসনের দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এনবিআর বাতিলের মাধ্যমে কর প্রশাসনের নিজস্বতা ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে সরকারের রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন গঠিত ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’-এর মাধ্যমে আরও দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে, সাধারণ জনগণ ও ব্যবসায়ী সমাজের অনেকেই এনবিআরের এই হঠাৎ পরিবর্তনে বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন। অনেকেই মনে করছেন, কোনো রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এর হঠাৎ বিলুপ্তি এবং তার প্রতিবাদে কর্মকর্তাদের কলমবিরতির ঘটনা প্রমাণ করে যে, কাঠামোগত সংস্কারের আগে স্বচ্ছ পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত আলোচনার ও অংশগ্রহণমূলক নীতি নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার ও আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্রুত আলোচনা শুরু না হলে রাজস্ব প্রশাসনের এই অচলাবস্থা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে উভয় পক্ষেরই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা সময়ের দাবি।