বিমান বাহিনী প্রধান শেখ আব্দুল হান্নান ও পরিবারের ৩৮টি ব্যাংক হিসাব জব্দ, দুর্নীতি তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট টিম
দেশের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী এক প্রাক্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখা দিয়েছে। সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল (অব.) শেখ আব্দুল হান্নান, তার স্ত্রী তাহমিদা বেগম এবং তাদের পুত্র শেখ লাবিব হান্নানের নামে খোলা মোট ৩৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এসব হিসাব মিলিয়ে বর্তমানে মোট অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
২০২৫ সালের ২৪ মে, শনিবার—ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক জাকির হোসেন গালিব এ সংক্রান্ত আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে আদালতে এই আবেদন দাখিল করেন সংস্থার উপপরিচালক মো. তানজির হাসিব সরকার। আদালতের এই আদেশের ফলে তদন্তকারী সংস্থা এখন এসব ব্যাংক হিসাব পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে এবং সন্দেহভাজন অর্থের উৎস ও লেনদেনের গঠনমূলক বিশ্লেষণ করতে পারবে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, শেখ আব্দুল হান্নান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন, ঘুষ গ্রহণ, নিয়োগ বাণিজ্য, প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ আত্মসাৎ এবং বিদেশে অবৈধভাবে অর্থ পাচার। তাছাড়া, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা নিজেদের নামে বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে জ্ঞাত আয়ের বাইরে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছেন বলেও প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
এই অভিযোগগুলো নিরপেক্ষভাবে যাচাই করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির মূল দায়িত্ব হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পারিবারিক লেনদেন, সম্পদ অর্জনের ইতিহাস এবং সরকারি দায়িত্ব পালনকালে সম্ভাব্য অনিয়মের প্রমাণ সংগ্রহ করা।
অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে জানা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ তাদের মালিকানাধীন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের একাংশ হয়তো ইতোমধ্যে স্থানান্তরের চেষ্টা করেছেন বা অন্যের নামে স্থানান্তর করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ ধরনের কার্যক্রম তদন্তে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এবং ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য সেই সম্পদ পুনরুদ্ধার করা জটিল হয়ে পড়বে। এই সম্ভাবনা মাথায় রেখে দুদক অবিলম্বে ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং সম্পদ হস্তান্তরের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, যদি এখনই অভিযুক্তদের সম্পদ জব্দ করে তদন্তের আওতায় আনা না যায়, তাহলে তারা লেনদেনের তথ্য মুছে ফেলতে পারে বা আর্থিক কৌশলে সম্পদ গোপন করতে পারে, যা বিচার ও পুনরুদ্ধারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আদালত দুদকের এই যুক্তিকে যৌক্তিক মনে করে তাদের আবেদন মঞ্জুর করে।
জব্দ করা ৩৮টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে খোলা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে স্বল্পপরিচিত ছোট ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকের হিসাবও। হিসাবগুলোতে জমা রাখা মোট অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ১৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩২২ টাকা, যা দৃষ্টিতে কম মনে হলেও এই অর্থের উৎস, লেনদেন পদ্ধতি ও হস্তান্তর প্রক্রিয়া ঘিরে বড় ধরনের জালিয়াতির প্রমাণ মিলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ধরনের অর্থসঞ্চয়ের পেছনে ঘুষ, কমিশন, নিয়োগ বাণিজ্য কিংবা বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত অবৈধ অর্থ থাকতে পারে। অনুসন্ধানে এসব অর্থের উৎস নির্ধারণ করা হলে, তা ভবিষ্যতের বিচারিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
হিসাবগুলো জব্দের আদেশ পাওয়ার পর এখন দুদকের অনুসন্ধান টিম প্রতিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করবে। হিসাবধারীদের নামে জমা অর্থের উৎস কী, কে বা কারা নিয়মিতভাবে এই অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকা জমা রেখেছে বা উত্তোলন করেছে, তাতে কোনো বেনামি লেনদেন হয়েছে কিনা—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে। একই সঙ্গে, অভিযুক্তদের নামে থাকা জমি, ফ্ল্যাট, যানবাহনসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদের খোঁজও নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি অন্যন্য অস্থাবর সম্পদের হিসাবও খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে স্বর্ণালঙ্কার, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অফশোর অ্যাকাউন্ট। যদি এসব সম্পদের হদিস মেলে, তবে সেগুলোকেও আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে জব্দ বা অবরুদ্ধ করা হবে।
এয়ার চিফ মার্শাল (অব.) শেখ আব্দুল হান্নান দায়িত্ব পালনকালে কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচিত হন। যদিও সেই সময় এসব বিষয় জনসমক্ষে তেমনভাবে না এলেও, দুদকের চলমান অনুসন্ধানে নতুন তথ্য উঠে আসছে। বিশেষ করে নিয়োগ সংক্রান্ত স্বজনপ্রীতি এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ ছিল উল্লেখযোগ্য। এসবের ওপর ভিত্তি করেই তদন্তের পরিসর এখন আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
এই ধরনের তদন্ত ও সম্পদ জব্দের ঘটনা দেশের দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রভাবশালী সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও যে সুষ্ঠুভাবে আইন প্রয়োগ হতে পারে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। জনস্বার্থ রক্ষায় এ ধরনের পদক্ষেপ শুধুমাত্র দুর্নীতি দমনেই সহায়ক নয়, বরং অন্যান্য দপ্তর ও কর্মকর্তাদেরও সতর্ক করে দেয় যে, জবাবদিহিতার বাইরে কেউ নয়।