গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক অনন্য প্রযুক্তিনির্ভর সংঘাতে। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে যেখানে মুখোমুখি সংঘর্ষ, ট্যাঙ্ক এবং গোলাবারুদের ব্যবহার প্রধান ছিল, এখন সেখানে আধিপত্য বিস্তার করছে ড্রোন প্রযুক্তি। উভয় পক্ষই নিজেদের সামরিক শক্তিকে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে ড্রোনকে একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যুদ্ধের গতিপথ বদলে দিতে এবং শত্রুপক্ষের ভেতরে সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত হানতে ড্রোনের ব্যবহারে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
ইতোমধ্যেই রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ হাজার হাজার ড্রোন মোতায়েন করেছে। এই ড্রোনগুলো শুধু নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না, বরং সেগুলো বোমা বহন করে শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও কম দামে তৈরি ‘কামিকাজে ড্রোন’ প্রচলিত গোলাবারুদের চেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।
ড্রোন ব্যবহারের কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে যে পরিমাণ মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে তা উদাহরণযোগ্য। সৈন্যদের জীবনযাপন এখন আর আগের মতো নিরাপদ নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, সৈন্যরা টয়লেট কিংবা যানবাহনের মধ্যে ড্রোন হামলার শিকার হচ্ছেন, এমনকি প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এটি যুদ্ধের এক নির্মম বাস্তবতা, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রের নিরাপদ স্থান বলে কিছু নেই।
ড্রোন প্রযুক্তির এই ব্যাপক ব্যবহারে বাধ্য হয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশই নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল খুঁজতে শুরু করেছে। ড্রোন প্রতিহত করতে তারা ইলেকট্রনিক জ্যামিং সিস্টেম, অ্যান্টি-ড্রোন গান এবং এমনকি সাধারণ কৃষকদের শটগান পর্যন্ত ব্যবহার করছে। সেনা ছাউনিগুলোতে এখন আগের চেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। একাধিক রিপোর্টে দেখা গেছে, সৈন্যদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং এই চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের এই ধরণ ‘অসামান্যতা’ (asymmetry) তৈরি করছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে দুর্বল পক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তিশালী পক্ষের বিরুদ্ধে বড়সড় আঘাত হানতে সক্ষম হচ্ছে। এটি যুদ্ধের প্রচলিত ধারা থেকে এক বড় বিচ্যুতি।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের বাহিনী ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অগ্রসর হয়েছে। রুশপন্থী যুদ্ধ-ব্লগারদের মতে, রুশ সেনারা ডোনেটস্ক অঞ্চলে পোকরোভস্ক এবং কোস্টিয়ানটিনিভকার মধ্যবর্তী এলাকায় ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে ঢুকে পড়েছে। তবে ইউক্রেনীয় পক্ষ এই দাবিগুলোকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি।
এই যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতি মূলত স্থানীয় এবং সীমিত হলেও মনোবল বৃদ্ধির জন্য তা উভয় পক্ষেই প্রচারিত হচ্ছে। তথাপি, ব্যাপক ড্রোন হামলার কারণে এই অগ্রগতি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ শুধু সামরিক দিক থেকেই নয়, মানবিক দিক থেকেও গভীর প্রভাব ফেলছে। ড্রোন হামলা এখন যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ফেলছে। বহু গ্রাম এবং শহর বারবার আকাশ থেকে চালানো হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। অসংখ্য মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, অনেক শিশু ও বৃদ্ধ আহত বা নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে, সৈন্যদের উপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও বেড়ে চলেছে। ড্রোন সবসময় আকাশে ঘুরতে থাকায় নিরবিচারে হামলার আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। এই পরিস্থিতিতে কেউ নিরাপদ নয়— এমন একটি মেসেজ প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধক্ষেত্রে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই যুদ্ধ শিগগিরই থামার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। বরং নতুন প্রযুক্তির সংযোজন এবং যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবর্তন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে। ড্রোন প্রযুক্তি এখন কেবল এক কৌশলগত হাতিয়ার নয়, বরং যুদ্ধের গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণে একটি মুখ্য উপাদান হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই যুদ্ধ বন্ধে নানা কূটনৈতিক প্রয়াস চালালেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। বরং যুদ্ধের প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, কারণ এই প্রযুক্তি অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ও অন্যান্য প্রকাশিত প্রতিবেদন।