২০১৯ সালে কোরিয়ান নির্মাতা হোয়াং ডং-হিউকের কল্পনায় জন্ম নেয় এক ভয়ংকর অথচ বাস্তবতাসম্মত টেলিভিশন জগত—স্কুইড গেম। প্রথম সিজনের সাফল্য ও বৈশ্বিক প্রভাবের পর দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য। অবশেষে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে মুক্তি পেল সিজন ৩, যা আগের সিজনগুলোর তুলনায় আরও বেশি রক্তাক্ত, দার্শনিক ও আবেগঘন।
এই সিজনে মৃত্যু ছিল অপরিহার্য, কিন্তু প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে ছিল মানবিক গল্প, আত্মত্যাগ এবং নিছক নিষ্ঠুরতার ছবি। আসুন, সিজন ৩-এর প্রতিটি পর্বের মূল ঘটনা, মৃত্যু এবং সামাজিক প্রতিফলন নিয়ে বিশ্লেষণ করি।
স্কুইড গেম সিজন ২-এর বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর পর্দা উঠলো এক নির্মম প্রতিশোধপর্বে। বিদ্রোহে অংশ নেওয়া অনেক চরিত্রই শুরুতেই নির্মমভাবে হত্যা হয়:
মৃতদের তালিকা:
ও ইয়ং-ইল (Player 001)
সন হান-নাম (Player 015)
কোয়ান বায়ং-সু (Player 047)
Player 072, 145, 206, 324
পার্ক জং-বে (Player 390)
নোটযোগ্য ঘটনা:
গার্ড নো-উল (Park Gyu-young) প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অবৈধ অঙ্গ ব্যবসায়ীদের হত্যা করে।
তিনি চেষ্টার মাধ্যমে গিয়ং-সক নামক প্লেয়ারকে বাঁচাতে চাইলেও অবশেষে তাকে নিজেই হত্যা করেন।
এই পর্বে “Hide and Seek” নামক এক ভয়ংকর খেলায় খেলোয়াড়দের শিকার করা হয়।
মৃত্যু তালিকা:
হিউন-জু (Player 120): প্রসব করিয়ে দেবার পরও মিয়ং-গি তাকে হত্যা করে।
সেওন-নিও: মিং-সুর মাদকাসক্তি hallucination-এর শিকার হয়ে মারা যান।
ডে-হো: তাকে হত্যা করে জি-হুন, যিনি বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে চান।
ইয়ং-সিক: মাকে হত্যা করতে চাওয়ায়, নিজ মায়ের (গিউম-জা) হাতে ছুরিকাহত হন এবং পরে গার্ডদের গুলিতে নিহত হন।
এই পর্বটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে ভারী। VIP-রা সৈনিক সেজে বাদ পড়া খেলোয়াড়দের গোপনে হত্যা করে।
নির্মম মুহূর্ত:
গিউম-জা: নিজের ছেলেকে খুন করার অপরাধে আত্মহত্যা করেন।
নাম-গিউ: মাদক থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে “Jump Rope” খেলায় মৃত্যুবরণ করেন।
এক ভয়ংকর পর্ব, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই আতঙ্কের।
জুন-হি: সন্তান জন্ম দেওয়ার পর, আহত অবস্থায় আত্মত্যাগ করে সন্তানের জন্য।
ক্যাপ্টেন পার্ক: ফ্রন্ট ম্যানের আদেশ পালনের কথা স্বীকার করে, কিন্তু জুন-হোর হাতে হারপুন গুলিতে নিহত হন।
এই পর্বে “Sky Squid Game” নামে এক ভয়ংকর খেলায় প্রতিযোগীরা একে অপরকে হত্যা করতে বাধ্য হয়।
মৃত্যু তালিকা:
মিং-সু: মাদকাসক্তি ও দুর্বলতার কারণে সহজ শিকার হয়ে মারা যায়।
Player 336, 353, 203, 100, 039: পরস্পরের হাতে প্রাণ হারায়।
শেষ তিন খেলোয়াড়:
মিয়ং-গি, জি-হুন এবং Player 222—অর্থাৎ জুন-হির নবজাতক সন্তান।
এক হৃদয়বিদারক সমাপ্তি।
মিয়ং-গি, নিজের সন্তানকে খুন করতে চায় যাতে সে জয়ী হতে পারে।
জি-হুন তাকে বাধা দেয়, ধস্তাধস্তির মাঝে মিয়ং-গি পড়ে গিয়ে মারা যায়।
কিন্তু “গেম শুরু বোতাম” চাপা হয়নি বলে এটি গণ্য হয় না।
জি-হুন নিজের জীবন বিসর্জন দেয়, বোতাম চাপ দিয়ে নবজাতককে বিজয়ী করে তোলে।
শেষ দৃশ্যে, Cate Blanchett–এর উপস্থিতি গোটা দর্শককেই চমকে দেয়।
তিনি একজন আমেরিকান নিয়োগকর্তা, যিনি “Ddakji” খেলায় অংশ নিচ্ছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের গলিতে।
এই দৃশ্য দেখায়—খেলাটি থামেনি, বরং তা আরও ছড়াচ্ছে।
পরিচালক হোয়াং ডং-হিউক বলেন,
“আমরা এমন একজনকে চেয়েছিলাম যার দুই শব্দেই প্রভাব পড়ে। Cate Blanchett তার অভিনয়ে তা বাস্তব করলেন।”
শেষ সিজনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ফোরামে দর্শকদের অভিব্যক্তি দ্বিধাবিভক্ত:
কেউ কেউ বলছেন:
“জি-হুনের আত্মত্যাগ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। এটা ফেক দয়া ছিল।”
অন্যরা বলছেন:
“এই সমাপ্তি ছিল আসলেই মানবতার প্রতিচ্ছবি। আমরা এমনই, কখনো সহানুভূতিশীল, কখনো নির্মম।”
এই নাটকের পেছনে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতা আরও গভীর:
2009 সালের SsangYong মোটর শ্রমিক আন্দোলন—জি-হুনের গল্পের অনুপ্রেরণা।
শ্রমিক সমস্যা, বেকারত্ব, আত্মহত্যা—এমন বাস্তব দুঃখকে কল্পনার রঙে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুইড গেমে।
একজন কোরিয়ান মন্তব্য করেছেন:
“স্কুইড গেম হলো বাস্তবতার চেয়েও বাস্তব।”
শেষ দৃশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খেলাটি ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দর্শকদের মনে প্রশ্ন তৈরি করে—“গেম কি সত্যিই শেষ হলো?”
পরিচালক বলেন:
“সবাই ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা করে। কেউ গেম চায়, কেউ বার্তা। কিন্তু জি-হুনের আত্মত্যাগ, কঠিন হলেও মানবতাকে তুলে ধরেছে।”
স্কুইড গেম সিজন ৩ আমাদের দেখিয়েছে, মানবতা কতোটা বেদনাদায়ক, কতোটা পরিহাসপূর্ণ, আবার একই সাথে কতোটা জ্যোতির্ময়।
জি-হুনের আত্মত্যাগ, ক্যাপ্টেন পার্কের স্বীকারোক্তি, গিউম-জার অনুশোচনা, ও এক নবজাতকের জয়—সব মিলিয়ে এটা শুধুই একটি সিরিজ নয়, একটি দার্শনিক কাব্য।