বর্তমান যুগে স্মার্টফোন যেন আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। শুধু যোগাযোগ নয়, বিনোদন, শিক্ষা, ব্যবসা, এমনকি দৈনন্দিন অনেক প্রয়োজনীয় কাজেই আমরা স্মার্টফোনের উপর নির্ভরশীল। ফলে একটি মানসম্মত স্মার্টফোন বাছাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেকেই হঠাৎ করেই ফোন কিনে ফেলেন, পরে বুঝতে পারেন সেটি তাদের প্রয়োজন বা বাজেটের সঙ্গে মানানসই নয়। তাই স্মার্টফোন কেনার আগে কিছু বিষয় জানা ও যাচাই করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিচে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরা হলো:
প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে আপনি ফোনটি কী কাজে ব্যবহার করবেন। কারো কাছে ফোন কেবল কল রিসিভ করার যন্ত্র, আবার কারো কাছে এটি ভিডিও এডিটিং, গেমিং বা ফটোগ্রাফির জন্য ব্যবহারযোগ্য একটি শক্তিশালী ডিভাইস। তাই আপনি যদি শুধু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, কল এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিং-এর জন্য ফোন কিনতে চান, তাহলে মিড-রেঞ্জ ফোনই যথেষ্ট। কিন্তু আপনি যদি হাই-এন্ড গেম বা ভিডিও প্রোডাকশন করতে চান, তাহলে শক্তিশালী প্রসেসর ও RAM সহ একটি ফোন দরকার হবে।
স্মার্টফোনের দামের পরিসর অনেক বড় — ১০ হাজার টাকার ফোন যেমন বাজারে আছে, তেমনি ২ লাখ টাকার ফোনও পাওয়া যায়। তাই আপনার প্রয়োজন বুঝে একটি বাজেট নির্ধারণ করে তার মধ্যে সেরা ফোনটি খোঁজা উচিত। অপ্রয়োজনীয় দামী ফোন কিনে পরে আর্থিক সমস্যায় পড়ার চেয়ে, যুক্তিসঙ্গত বাজেটের মধ্যে ভালো ফোন বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটি স্মার্টফোনের “মগজ” হচ্ছে তার প্রসেসর। বাজারে এখন বিভিন্ন ধরনের প্রসেসর ব্যবহৃত হচ্ছে যেমন Qualcomm Snapdragon, MediaTek, Exynos বা Apple A সিরিজ। গেমিং, মাল্টিটাস্কিং বা হেভি অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রসেসর যেমন Snapdragon 7 বা 8 সিরিজ, অথবা Apple A সিরিজের চিপ ব্যবহার করা ফোন কেনা ভালো। আবার হালকা ব্যবহারের জন্য মিড-রেঞ্জ প্রসেসর যেমন Snapdragon 6 সিরিজ বা MediaTek Helio G সিরিজ যথেষ্ট।
RAM (Random Access Memory) ফোনের গতির উপর প্রভাব ফেলে। ৪ জিবি RAM এখন অন্তত ন্যূনতম বিবেচনা করা উচিত। গেমিং বা হেভি ইউজারের জন্য ৬ বা ৮ জিবি RAM দরকার হতে পারে। একইভাবে, ১২৮ জিবি স্টোরেজ এখন স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গেছে। তবে আপনার যদি অধিক ভিডিও, ছবি বা অ্যাপ সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়, তাহলে ২৫৬ জিবি বা তার বেশি স্টোরেজ বিবেচনা করুন। পাশাপাশি microSD কার্ড সাপোর্ট আছে কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
বড় স্ক্রিন ও হাই-স্পিড প্রসেসরের কারণে স্মার্টফোনের ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়। তাই ৪৫০০ mAh থেকে ৬০০০ mAh ব্যাটারির ফোন নির্বাচন করা ভালো। ফাস্ট চার্জিং সাপোর্ট থাকলে আরও ভালো। ৩০ ওয়াট, ৪৫ ওয়াট বা ৬৭ ওয়াট চার্জিং প্রযুক্তি এখন অনেক ফোনে পাওয়া যায়, যা খুব দ্রুত চার্জ পূর্ণ করতে সক্ষম।
বর্তমানে অনেকেই স্মার্টফোন দিয়ে ছবি বা ভিডিও ধারণ করেন। তাই ক্যামেরার গুণমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে ক্যামেরা মেগাপিক্সেলের উপর নির্ভর করে না বরং সেন্সর, অপটিক্যাল ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন (OIS), অ্যাপারচার এবং AI প্রসেসিং—এই বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হয়। যারা ক্যামেরা-কেন্দ্রিক ফোন খুঁজছেন, তারা রিভিউ দেখে বুঝে নেবেন কোন ফোনে বাস্তব অভিজ্ঞতা ভালো।
একটি ফোনের স্ক্রিন হলো তার সবচেয়ে বড় ইন্টারফেস। AMOLED ডিসপ্লে সাধারণত বেশি কালারফুল ও ব্যাটারি সাশ্রয়ী হয়। IPS LCD ডিসপ্লেও এখনো অনেক ভালো মানের হয়। যারা ভিডিও স্ট্রিমিং, গেমিং বা গ্রাফিকসের কাজ করেন, তাদের জন্য AMOLED এবং উচ্চ রিফ্রেশ রেট (৯০Hz বা ১২০Hz) স্ক্রিন থাকা ফোন উপযুক্ত।
Android এবং iOS—এই দুটি প্রধান অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে। iOS শুধুমাত্র Apple এর ডিভাইসে ব্যবহৃত হয়, অন্যদিকে Android আছে অনেক ব্র্যান্ডে যেমন Samsung, Xiaomi, Vivo, Oppo ইত্যাদি। Android ফোনে ভিন্ন ভিন্ন UI (User Interface) থাকে যেমন MIUI, One UI, ColorOS ইত্যাদি। কোন UI আপনার জন্য সুবিধাজনক হবে তা দেখে নিতে পারেন।
বর্তমান সময়ে ৫জি (5G) সাপোর্টেড ফোনের চাহিদা বাড়ছে। যদিও অনেক দেশে এখনো ৫জি পুরোপুরি চালু হয়নি, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ৫জি ফোন নেওয়া একটি ভাল সিদ্ধান্ত হতে পারে। এছাড়া ব্লুটুথ, Wi-Fi ভার্সন, NFC, ইনফ্রারেড ইত্যাদি কানেক্টিভিটি অপশনগুলো যাচাই করে নিন।
ব্র্যান্ডের সুনাম ও তাদের কাস্টমার সার্ভিস অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক ভালো ফোনও বাজারে আছে, কিন্তু সার্ভিস সেন্টার না থাকায় ছোট সমস্যায় ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই জনপ্রিয় ও বিশ্বস্ত ব্র্যান্ডের ফোন কিনুন এবং নিশ্চিত হন যে নিকটস্থ সার্ভিস সেন্টার আছে কিনা।
ফোনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস আনলক, নিরাপদ ফোল্ডার ইত্যাদি সিকিউরিটি ফিচার থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, ফোনটির সফটওয়্যার আপডেট কতদিন পর্যন্ত পাওয়া যাবে, তা যাচাই করা উচিত। অনেক ব্র্যান্ড নিয়মিত সিকিউরিটি ও সফটওয়্যার আপডেট দেয়, যা ফোনকে সুরক্ষিত রাখে এবং নতুন ফিচার উপভোগ করতে সাহায্য করে।
উপসংহার:
একটি স্মার্টফোন শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি এখন জীবনযাপনের অংশ। তাই না ভেবে না বুঝে, শুধুমাত্র চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেখে ফোন কেনা উচিত নয়। বরং নিজের প্রয়োজন, বাজেট ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা বিবেচনা করে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে ফোন কেনাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। সচেতন সিদ্ধান্তই এনে দিতে পারে দীর্ঘমেয়াদী সন্তুষ্টি ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা।