কাতার এয়ারওয়েজ (Qatar Airways) বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রিমিয়াম আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের কাতার থেকে পরিচালিত এই এয়ারলাইনটি অল্প সময়েই আকাশ পরিবহনের জগতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্বজুড়ে বিলাসবহুল পরিষেবা, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভরতা এবং অসাধারণ কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্সের কারণে কাতার এয়ারওয়েজ বর্তমানে “ফাইভ-স্টার” এয়ারলাইন হিসেবে পরিচিত।
কাতার এয়ারওয়েজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে এবং ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তবে ১৯৯৭ সালে আমূল পুনর্গঠন এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার অধীনে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে CEO হিসেবে যোগ দেন আকবর আল বেকার (Akbar Al Baker)। এই নেতৃত্বের অধীনে কাতার এয়ারওয়েজ দ্রুত উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয় এবং শীঘ্রই মধ্যপ্রাচ্যের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে।
কাতার এয়ারওয়েজ-এর প্রধান কার্যালয় অবস্থিত দোহা, কাতারে। এর মূল অপারেশনাল হাব হলো হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (Hamad International Airport – DOH), যেটি বিশ্বমানের অবকাঠামো এবং যাত্রীসেবার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত।
২০২৫ সালের হিসাবে, কাতার এয়ারওয়েজ বিশ্বের প্রায় ১৭০টির বেশি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। এই গন্তব্যগুলো ছড়িয়ে আছে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশজুড়ে। এর মধ্যে জনপ্রিয় রুটসমূহ হলো:
লন্ডন – দোহা
নিউ ইয়র্ক – দোহা
ঢাকা – দোহা
সিডনি – দোহা
টোকিও – দোহা
কাতার এয়ারওয়েজের বহরে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও বিলাসবহুল বিমানের সমন্বয় রয়েছে। তাদের বিমানের তালিকায় রয়েছে:
Airbus A350-900 এবং A350-1000
Boeing 777-300ER এবং 777X
Boeing 787 Dreamliner
Airbus A380 (সীমিত পরিসরে)
প্রতিটি বিমানেই রয়েছে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ককপিট, শক্তিশালী পরিবেশবান্ধব ইঞ্জিন এবং যাত্রীদের জন্য বিশ্বমানের সুবিধা।
প্রশস্ত সিট
১১-১৩ ইঞ্চি স্ক্রিনে In-flight Entertainment (Oryx One)
হালকা খাবার ও ডিনার
বিনামূল্যে Wi-Fi (নির্দিষ্ট ফ্লাইটে)
Qsuite – ব্যক্তিগত স্যুট কেবিন
ফ্ল্যাটবেড সিট
Al Mourjan লাউঞ্জ অ্যাক্সেস
Gourmet ডাইনিং এবং ওয়াইন নির্বাচন
আলাদা কেবিন অভিজ্ঞতা
ঘুমানোর জন্য বিছানা
আলাদা টয়লেট এবং প্রাইভেসি ব্যবস্থা
VIP লাউঞ্জ এবং প্রিমিয়াম সেবা
Qatar Airways-এর নিজস্ব মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম Oryx One-এ রয়েছে হাজারো চলচ্চিত্র, মিউজিক, টিভি শো, গেম এবং ডকুমেন্টারি। প্রত্যেক সিটে থাকে টাচস্ক্রিন ডিসপ্লে এবং নয়েজ-ক্যানসেলিং হেডফোন।
দোহা হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবস্থিত Al Mourjan Business Lounge বিশ্বসেরা লাউঞ্জগুলোর একটি। এতে রয়েছে:
বিলাসবহুল রেস্ট এরিয়া
আলাদা ডাইনিং রেস্টুরেন্ট
ফ্যামিলি এরিয়া
শাওয়ার সুবিধা ও ঘুমানোর জায়গা
Qatar Airways অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। উল্লেখযোগ্য কিছু:
Skytrax “World’s Best Airline”: ২০১১, ২০১২, ২০১৫, ২০১৭, ২০১৯, ২০২১, ২০২২ সালে।
World’s Best Business Class: বহুবার বিজয়ী
Best Airline in the Middle East
5-Star Airline রেটিং (Skytrax)
মালিকানা: কাতার সরকারের পূর্ণ মালিকানাধীন
CEO: আকবর আল বেকার (1997–2024 পর্যন্ত, বর্তমান সময়েও যুক্ত)
সহযোগী প্রতিষ্ঠান:
Qatar Executive (প্রাইভেট জেট সার্ভিস)
Qatar Duty Free
Hamad International Airport (ম্যানেজমেন্ট)
Qatar Airways Cargo
Qatar Airways হলো Oneworld Alliance-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যার ফলে যাত্রীরা অন্য সদস্য এয়ারলাইনের সাথেও মিলিত সুবিধা পেয়ে থাকেন। উল্লেখযোগ্য পার্টনার এয়ারলাইন:
British Airways
American Airlines
Malaysia Airlines
Japan Airlines
Qatar Airways পরিবেশ রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে:
নতুন প্রজন্মের জ্বালানি-সাশ্রয়ী বিমান
কার্বন নির্গমন হ্রাস পরিকল্পনা
প্লাস্টিক ব্যবহার হ্রাস ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ
সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রকল্প যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা
COVID-19 মহামারির সময় কাতার এয়ারওয়েজ অন্যান্য এয়ারলাইনের তুলনায় দ্রুত এবং নিরাপদ পরিষেবা চালু রাখে। স্বাস্থ্যবিধি, PPE পরিধান, HEPA ফিল্টার সিস্টেম এবং কনট্যাক্টলেস পরিষেবার মাধ্যমে যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশ থেকে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট রয়েছে প্রধানত ঢাকা–দোহা রুটে, প্রতিদিন একাধিক ফ্লাইট পরিচালিত হয়। ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শহরে যাত্রার জন্য কাতার এয়ারওয়েজ অন্যতম জনপ্রিয় ট্রানজিট অপশন।
Qatar Airways আগামী কয়েক বছরে আরও নতুন গন্তব্য, উন্নততর বিমান, এবং কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্সে আরও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে:
Sustainable Aviation Fuel (SAF) ব্যবহারে বিনিয়োগ
AI ও Chatbot সাপোর্ট সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন
নতুন Qsuite ডিজাইন
নতুন গন্তব্য যেমন আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ অঞ্চল ও ল্যাটিন আমেরিকা
যদিও কাতার এয়ারওয়েজ বিশ্বসেরা সার্ভিস প্রদান করে, তবে কিছু বিতর্ক ও সমালোচনাও ছিল:
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন (বিশেষ করে গাল্ফ অঞ্চলে)
মহামারির সময় কিছু কর্মী ছাঁটাই
উচ্চ টিকিট মূল্য
তবে কোম্পানি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার ও নিরাপত্তা নীতিতে অগ্রণী অবস্থানে রয়েছে।
Qatar Airways এখন কেবল কাতারের গর্ব নয়, বরং বিশ্ব বিমানসেবার একটি আদর্শ মডেল। বিলাসবহুল সেবা, প্রযুক্তিনির্ভর অপারেশন, এবং উন্নততর যাত্রীসন্তুষ্টি নিশ্চিত করে কাতার এয়ারওয়েজ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এয়ারলাইনগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। প্রতিটি যাত্রায় তাদের মূলমন্ত্র: “Going Places Together”। এই বিমানসংস্থার লক্ষ্য শুধু গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, বরং প্রতিটি মুহূর্তকে এক অনন্য অভিজ্ঞতায় পরিণত করা।