বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের দীর্ঘস্থায়ী সংস্কৃতির বিষয়ে জাতিসংঘ সম্প্রতি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে বাহিনীগুলোর নির্মম ও বেপরোয়া ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে এতে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী চূড়ান্ত হিংস্র হয়ে ওঠে। তারা নির্বিচারে নির্যাতন চালায় এবং বহু আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। এ ধরনের বর্বরতার পেছনে ক্ষমতাসীন দল ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে গড়ে ওঠা নেতিবাচক সহাবস্থানমূলক সম্পর্ককে দায়ী করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের অপরাধে হস্তক্ষেপ না করার বিনিময়ে বাহিনীগুলোও নিজেদের অপকর্মে দায়মুক্তি পেয়ে থাকে।
বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ভয়াবহ চিত্র
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ২০০৯ সাল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন অপকর্ম এবং তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংস্থা প্রায় ২,৫৭৯টি বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং ৭০৮টি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।
এর মধ্যে শুধু র্যাবই ৮০০টি হত্যাকাণ্ড ও ২০০টি গুমের সঙ্গে জড়িত। তবে এখন পর্যন্ত র্যাব কর্মকর্তাদের মাত্র একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, যেখানে নিহতদের একজন ছিলেন স্থানীয় ক্ষমতাধর এক আওয়ামী লীগ নেতা।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১৭০টির বেশি গুমের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এই সংস্থার কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নির্যাতনের সংস্কৃতি ও বিচারহীনতা
জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা নিয়মিত ঘুষ আদায় ও স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ব্যাপক নির্যাতন চালায়। ২০১৩ সালে সরকার ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ পাস করলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ হয়নি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই আইন কার্যকর হওয়ার পরও কমপক্ষে ১০৩ জন বন্দি নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। কিন্তু সরকার মাত্র ২৪টি মামলা আমলে নিয়েছে, এবং এর মধ্যে শুধু একটি মামলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আইনি কাঠামোতেই দায়মুক্তির সুযোগ
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতেই নিরাপত্তা বাহিনীর দায়মুক্তির সুযোগ বিদ্যমান। বিশেষ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩২ ধারা অনুসারে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। এছাড়া, তারা যদি ‘সরল বিশ্বাসে’ কোনো কাজ করেন, তবে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।
এ ধরনের আইনি বিধান অপরাধীদের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সহজতর করে তোলে এবং দোষীদের বিচার থেকে রক্ষা দেয়।
বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ভয়াবহ দুরবস্থার চিত্রও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, দেশের বিচার বিভাগ তহবিল সংকটে ভুগছে এবং বর্তমানে ৪২ লাখ মামলা ঝুলে আছে, যার মধ্যে ফৌজদারি মামলাই ২৪ লাখ।
সময় যত গিয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং এটি ব্যাপকভাবে রাজনীতিকীকরণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যা বিচারকদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
২০১৬ সালে সংসদ একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করে, যার মাধ্যমে সংসদ বিচারকদের সরাসরি অপসারণের ক্ষমতা লাভ করে। তবে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট সেই সংশোধনী বাতিল করে, এবং বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরিয়ে দেয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অকার্যকারিতা
প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC) স্বাধীনতার অভাব, ক্ষমতাহীনতা এবং রাজনীতিকরণের শিকার। ফলে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিণতি
জাতিসংঘের মতে, দায়মুক্তির সংস্কৃতি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারদের জন্য ন্যায়বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক অবিশ্বাস স্থায়ী হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে এবং সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে।
প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, অমীমাংসিত মানবাধিকার লঙ্ঘন বাংলাদেশে আরও ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে পারে।