বর্তমান সময়ে আমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করছি অনেকটা “একবার ব্যবহার করে ফেলে দাও” নীতিতে। ফোনে যদি ব্যাটারি সমস্যা হয়, ক্যামেরা খারাপ হয়ে যায়, বা পারফরম্যান্স কমে – তখন প্রায়শই আমাদের পুরো ফোন বদলাতে হয়। এই প্রবণতা শুধু ব্যয়বহুলই নয়, একই সঙ্গে প্রকৃতির জন্যও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। প্রতি বছর লাখ লাখ টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য জমা হচ্ছে, যার অধিকাংশই ব্যবহৃত বা পুরনো স্মার্টফোন।
এই প্রেক্ষাপটে Yanko Design সম্প্রতি একটি অনন্য কনসেপ্ট উপস্থাপন করেছে – H-One Pro। এটি একটি মডুলার স্মার্টফোন, যেখানে প্রতিটি অংশ (যেমন: ক্যামেরা, ব্যাটারি, প্রসেসর, ইত্যাদি) আলাদা করে বদলানো, আপগ্রেড বা কাস্টমাইজ করা যায়। এটি শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং ইলেকট্রনিক বর্জ্য কমানোর একটি দিকনির্দেশক উদ্যোগও।
H-One Pro এর মূল কাঠামোটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে ফোনের প্রতিটি অংশ (মডিউল) আলাদাভাবে সংযুক্ত থাকে এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করা যায়। ফোনের পেছনে একটি স্লাইডিং কাভার রয়েছে যা খুললেই ক্যামেরা, ব্যাটারি, প্রসেসর, স্টোরেজ, স্পিকার সহ বিভিন্ন মডিউল দৃশ্যমান হয়।
প্রতিটি মডিউল যুক্ত থাকে ম্যাগনেটিক কনেকশন-এর মাধ্যমে, অর্থাৎ চুম্বকের সাহায্যে। এটি ফোনের সৌন্দর্য বজায় রেখে ব্যবহারকারীর জন্য সহজ অপারেশন নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে লোকিং সিস্টেম থাকায় মডিউল খুলে পড়া বা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।
ব্যবহারকারী নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ক্যামেরা মডিউল পরিবর্তন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:
স্ট্যান্ডার্ড ক্যামেরা থেকে আল্ট্রা-ওয়াইড
টেলিফটো থেকে নাইট ভিশন ক্যামেরা
ফটোগ্রাফি পছন্দ করেন? তাহলে নিজের পছন্দের ক্যামেরা সংযুক্ত করেই একটি পার্সোনালাইজড ফোন বানিয়ে ফেলুন।
যাদের ফোনে দীর্ঘ সময় চার্জ দরকার, তারা H-One Pro–তে হাই-ক্যাপাসিটি ব্যাটারি মডিউল বসাতে পারেন। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাটারির আয়তন বা ধারণক্ষমতা পরিবর্তন করা যাবে।
চাইলে পরবর্তী সময়ে ফোনের পারফরম্যান্স বাড়ানোর জন্য নতুন প্রসেসর মডিউল বা স্টোরেজ মডিউল সংযুক্ত করা যাবে। এতে করে একটি পুরনো ফোনেও আধুনিক স্পেসিফিকেশন যুক্ত করা সম্ভব।
সংগীতপ্রেমীদের জন্য ভালো খবর! এখানে হাই-কোয়ালিটি সাউন্ড মডিউল বসানো যাবে, যার মাধ্যমে মিউজিক বা ভিডিওর অভিজ্ঞতা হবে আরও উন্নত।
H-One Pro–র ডিজাইন ফিউচারিস্টিক এবং মিনিমালিস্ট। সামনের অংশে ফ্ল্যাট ফুলস্ক্রিন ডিসপ্লে এবং পাতলা বেজেল, পেছনের দিকে অ্যালুমিনিয়াম ও গ্লাস ফিনিশ।
যদিও এটি একটি মডুলার ফোন, তবুও এটি মোটা বা ভারী নয়। মডিউলগুলো কম্প্যাক্ট এবং ফিটিং প্রিসিশন ভালোভাবে হিসাব করে ডিজাইন করা হয়েছে।
প্রতি বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার বড় অংশই আসে স্মার্টফোন থেকে। H-One Pro শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় অংশ পরিবর্তনের সুযোগ দিয়ে ফোন বদলানোর প্রবণতা কমিয়ে দিতে পারে। এটি সার্কুলার ইকোনমি-র দৃষ্টান্ত।
এই ফোন ব্যবহার করে একজন ব্যবহারকারী ৫ থেকে ১০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় একই ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবেন, শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় অংশ আপগ্রেড করে।
যারা চান নিজের ফোনে নিজস্ব পছন্দের ক্যামেরা, পারফরম্যান্স, সাউন্ড সিস্টেম – তাদের জন্য H-One Pro একটি আদর্শ কনসেপ্ট। এটি প্রযুক্তিকে আরো ব্যক্তিগত করে তোলে।
এই ধারণা বাস্তবায়ন হলে বড় বড় স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ডিজাইন ও প্রোডাকশন স্ট্র্যাটেজি বদলাতে বাধ্য হবে।
মডুলার ফোন মানে মেরামতের জন্য আলাদা করে মডিউল সরবরাহ বা রিপ্লেসমেন্ট সেবা তৈরি হবে। এতে করে নতুন রেভিনিউ স্ট্রিম তৈরি হতে পারে।
সাসটেইনেবল প্রোডাক্ট ডিজাইন গ্লোবাল মার্কেটে জনপ্রিয় হচ্ছে। H-One Pro এর মতো কনসেপ্ট এই পরিবর্তনের গতি বাড়িয়ে দিতে পারে।
বর্তমানে গুগলের Project Ara এবং Fairphone-এর মতো কিছু উদ্যোগ মডুলার প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছে। কিন্তু এখনও এটি মূলধারার বাজারে জায়গা করে নিতে পারেনি। তবে Yanko Design-এর H-One Pro সেই সম্ভাবনাকে আবার সামনে এনেছে।
এছাড়া কোম্পানির দাবি অনুযায়ী H-One Pro–তে আগামী ২৫ বছর পর্যন্ত সফটওয়্যার আপডেট দেওয়া হবে, যা এখন পর্যন্ত বাজারে থাকা কোনো ফোনেই সম্ভব হয়নি।
চ্যালেঞ্জ | সম্ভাব্য সমাধান |
---|---|
১. মডুলার ফোনে স্ট্রাকচারাল দুর্বলতা | ম্যাগনেটিক + মেকানিক্যাল লকিং সিস্টেম |
২. কম্পোনেন্ট কনফ্লিক্ট | ইউনিভার্সাল মডিউল ইন্টারফেস তৈরি করা |
৩. হাই-এন্ড পারফরম্যান্স | কাস্টম আপগ্রেডযোগ্য চিপসেট ডিজাইন |
৪. দাম বেশি হতে পারে | ডগমা ভেঙে প্রযুক্তি মূলধারায় নিয়ে আসা |
H-One Pro কেবল একটি ফোন নয়; এটি একটি দর্শন – একটি নতুন ভাবনার নাম যেখানে প্রযুক্তিকে কেবল ব্যবহারের বস্তু নয়, বরং পরিবেশবান্ধব ও ব্যক্তিগতকৃতভাবে চিন্তা করা হয়েছে। এটি আমাদের সামনে এমন একটি সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়, যেখানে আমরা নিজের ফোনকেই নিজের মতো করে তৈরি করতে পারি।
যদিও এখনো কনসেপ্ট পর্যায়ে আছে, তবে Yanko Design-এর মতো বড় ডিজাইন প্ল্যাটফর্মে এর উপস্থাপন ভবিষ্যতে প্রযুক্তি নির্মাতাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে H-One Pro হতে পারে ২১শতকের সবচেয়ে পরিবর্তন আনয়নকারী মোবাইল উদ্ভাবন।