নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে ১২৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বিশেষ সহায়তা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন এবং তাদের ব্যবসায়িক পরিসর সম্প্রসারণে ১২৫ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি দেশের অর্থনৈতিক খাতে নারীদের অংশগ্রহণকে আরও বেগবান করতে এবং তাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সোমবার (২ জুন) বিকেলে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত বাজেট উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এই প্রস্তাব তুলে ধরেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি এবং এর জন্য প্রয়োজন তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, আর্থিক সহায়তা ও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ।
অর্থ উপদেষ্টা জানান, নারী উদ্যোক্তারা যেন সহজে তাদের উদ্যোগ শুরু করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই এই তহবিল গঠনের প্রস্তাব এসেছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই নারী উদ্যোক্তারা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন—যেমন প্রাথমিক মূলধনের অভাব, প্রশিক্ষণের সুযোগের ঘাটতি, এবং ব্যবসা পরিচালনায় সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক বাধা। এই তহবিলের মাধ্যমে এইসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে তাদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা হবে।
প্রস্তাবিত তহবিল ব্যবহারের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণ সুবিধা পেতে পারেন। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, নারী নেতৃত্বে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করা।
নারী উন্নয়নের অংশ হিসেবে বাজেট বক্তৃতায় ড. সালেহউদ্দিন আরও উল্লেখ করেন, দেশের বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে তোলা মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যাতে তারা নিজ উদ্যোগে আয়মুখী কার্যক্রম শুরু করতে পারেন।
জাতীয় মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমির আওতায় পরিচালিত বিভিন্ন দক্ষতা ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে নারীরা সেলাই, কম্পিউটার, হস্তশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এর ফলে তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন এবং অনেকেই সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন।
নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে “ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট ফর উইমেন” বা ভি.ডব্লিউ.বি কর্মসূচি। অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, এই কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে ২০ হাজার নারীকে দক্ষতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নারীদের শুধু আত্মনির্ভরশীল করে তোলে না, বরং তাদের পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও উন্নয়ন ঘটায়।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের অনেকেই ক্ষুদ্র ব্যবসা, হস্তশিল্প, কৃষি উদ্যোগ বা সেবামূলক পেশায় যুক্ত হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য সহজশর্তে ঋণ, বাজারে প্রবেশাধিকার এবং পরামর্শ সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, শুধু অর্থনৈতিক সহায়তাই নয়, নারীর নিরাপত্তা এবং সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। এই লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমিকে আরও সক্রিয় ও কার্যকর করার পাশাপাশি, উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কোর্স আধুনিকায়নের কাজ চলছে।
সরকার মনে করে, নারী উন্নয়ন শুধু একটি সামাজিক প্রয়োজন নয় বরং এটি একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজনও। কারণ, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী, এবং এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারী-উদ্যোক্তা বান্ধব বাজেট প্রণয়ন করে সরকার তাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশ্লেষকদের মতে, এই বাজেট প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ নারী উদ্যোক্তারা এখনও পর্যাপ্ত সহায়তা থেকে বঞ্চিত এবং তাদের ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিশেষ তহবিলের এই ঘোষণা তাদের জন্য এক ধরনের স্বীকৃতি এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
তবে, বিশ্লেষকেরা বলছেন, বরাদ্দকৃত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার, সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা গেলে এই উদ্যোগের কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া কঠিন হতে পারে। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও এবং বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় তহবিল ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।