সচিবালয়ে ‘জুলাই বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’র গণসমাবেশ: সংস্কারবিরোধী আমলাদের অপসারণের দাবি
২৭ মে ২০২৫ তারিখে রাজধানীর সচিবালয়ের সামনে জোরালো প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে ‘জুলাই বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনে, আব্দুল গণি সড়কে আয়োজিত এই গণসমাবেশে আমলাতান্ত্রিক সংস্কারবিরোধিতা ও ফ্যাসিবাদের অভিযোগ তুলে তীব্র প্রতিবাদ জানায় সংগঠনটি।
দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে অংশ নেয় অসংখ্য ছাত্র-জনতা। তারা হাতপাখা, প্ল্যাকার্ড এবং ব্যানার হাতে নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবাদী স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে। ‘আমলাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও’, ‘সচিবদের জমিদারি মানি না’, ‘ফ্যাসিস্ট আমলাদের বিচার চাই’—এমন নানা স্লোগানে তাদের অবস্থান কর্মসূচি স্পষ্ট করে তোলে।
এই গণসমাবেশের নেতৃত্ব দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব আরিফ সোহেল। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “সচিবালয়ে কিছু আমলা সংস্কারের বিপক্ষে গিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা তাদের অপসারণ দাবি করছি। একইসঙ্গে চাকরিবিধি নিয়ে যারা সরকারি অফিসে আন্দোলন করছে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”
আরিফ সোহেল আরও বলেন, “আমরা মনে করি এই আমলারা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় থেকে ফ্যাসিবাদের সহচর হিসেবে কাজ করছে। যারা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”
এই গণসমাবেশ এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন সচিবালয়ের অভ্যন্তরে সরকারি চাকরি সংশোধনী অধ্যাদেশ ২০২৫-এর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীরা চতুর্থ দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে কর্মচারীদের কর্মনীতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। তবে এই সংশোধনী নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে—একদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদ, অন্যদিকে কিছু ছাত্র ও নাগরিক সংগঠনের কড়া সমালোচনা।
‘জুলাই বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’র দাবি, এই সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আমলারা আসলে একটি অদৃশ্য স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তারা সরকারের পরিকল্পিত সংস্কার বাধাগ্রস্ত করছে। সংগঠনের নেতাদের মতে, এমন কর্মকর্তারা প্রশাসনে থেকে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নষ্ট করছেন।
গণসমাবেশ ঘিরে সচিবালয়ের আশপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল কঠোর। পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী সতর্ক অবস্থানে ছিল যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন শুরু থেকেই সচেতন ভূমিকা পালন করে।
অন্যদিকে, দুপুর ১২টার দিকে আন্দোলনরত কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ‘জুলাই মঞ্চ’-এর আহ্বায়ক আরিফ তালুকদার, মুখপাত্র সাকিব হোসেনসহ পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। তারা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং আন্দোলনের পেছনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন।
এই আন্দোলনে যে ধরনের স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছে, তা স্পষ্টতই রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। ‘শেখ হাসিনার দালালরা হুঁশিয়ার’ কিংবা ‘আওয়ামী লীগের দোসররা সাবধান’—এই ধরনের স্লোগান থেকে বোঝা যায় যে আন্দোলনের পেছনে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও জড়িত। তবে সংগঠনটি নিজেদের ‘ছাত্র ও জনতার’ যৌথ প্রতিচ্ছবি হিসেবে উপস্থাপন করে বলছে, তারা মূলত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন করছে।
এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের দাবি, আমলাতন্ত্রের দীর্ঘদিনের একচেটিয়া ক্ষমতা এখন ভাঙার সময় এসেছে। তারা বলেন, “আমলারা নিজেদের সুবিধার জন্য জনস্বার্থে আনা সংস্কারকে আটকে রাখছে। এটি মেনে নেওয়া যায় না।”
অন্যদিকে সচিবালয়ের ভেতরে আন্দোলনরত কর্মচারীরা সরকারের সাম্প্রতিক ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর বিরুদ্ধে তাঁদের বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা মনে করেন, নতুন আইনটি তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা খর্ব করবে।
এই দুই পক্ষের অবস্থানের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা যেখানে নিজেদের অধিকার রক্ষার কথা বলছেন, সেখানে ছাত্র-জনতা নামধারী এই সংগঠন সংস্কারের নামে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। ফলে, এই পরিস্থিতি অচিরেই বড় ধরনের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিতর্কে রূপ নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘জুলাই বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’র এই আন্দোলন প্রশাসনের ভেতরে বিরাজমান সংস্কারবিরোধী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এটি কেবল একটি ছাত্র বা রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং প্রশাসনিক কাঠামো ও সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ওপর সরাসরি প্রভাব রাখার মতো ঘটনা।
আগামী দিনে সরকার কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে গোটা দেশ। প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও জনসচেতনতা—দুয়ের দিক থেকেই এই আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে।